ব্রেকিংঃ

এরশাদ পতনের সেই দিনের স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে।

মনিরুল হক চৌধুরীঃ সম্ভবত ২০ শে নভেম্বর ১৯৯০ আমি তখন ৩০ বিজয় নগর মেডোনা এভার্টাইজিং এর অফিসে, সেখানে উপস্থিত শ্রদ্বেয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সাইফুদ্দিন মানিক, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও মোস্তফা মহসিন মন্টু।

তাদের আলোচনার মাঝখানে তোফায়েল চাচা দুই জায়গায় ফোন করে রাখার পর বললেন “ওরা আজই এ্যাকশনে যাচ্ছে সবাইকে এরেস্ট করবে, সিদ্ধান্ত হলো সবাই আত্মগোপন করবে, রাজ্জাক ভাই বললেন কে কোনদিকে যাবে? তোফায়েল চাচা মেডোনার মালিক কামাল ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন “তোমার বাসায় থাকলে অসুবিধা হবে? ” কামাল ভাই বললেন “না কোনো সমস্যা নাই”, মন্টু ভাই আর সুরঞ্জিত দা বললেন তারা অন্য জায়গায় যাবেন, বাকি ২ জন রাজ্জাক ভাই ও মানিক ভাইকে ৩/৪, ব্লক বি, লালমাটিয়া, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দিয়ে দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতে বললেন।
তোফায়েল চাচা যাওয়ার সময় কামাল ভাইকে বললেন তোমরা আসার সময় (আমাকে দেখিয়ে) বুলেটকে সাথে নিয়ে এসো।
তারা চলে যাওয়ার পর কামাল ভাই-হারুন ভাই খুব খুশি আমাকে নিয়ে যেতে বলার জন্য, এরই মধ্যে গত দুই বছরে এই দুই পরিবারে আমি একজন খুব প্রিয় মানুষ হয়ে গেছি, বৃহস্পতিবার আসলেই বাচ্চারা ফোন করে বলে রাখতো আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতে আবার শনিবার একসাথে অফিসে আসা হতো, তাদের সকল পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমাকে বলবেই, মোটকথা আমি তাদের পরিবারেরই একজন জনপ্রিয় অংশ হয়ে গেছি। কামাল ভাইয়ের বাসায় প্রথম যাই ১৯৮৩ তোফায়েল চাচা আত্মগোপনে এই বাসায় ছিল, আমি ঢাকায় তোফায়েল চাচার বাসায় গেলে চাচী বললেন “তোমার চাচা বাসায় থাকেনা তুমি দেখা করবে? চলো তোমাকে নিয়ে যাই” সেই প্রথম এই বাসায় যাওয়া আর তাদের সাথে পরিচয়। এরমধ্যে কামাল ভাই তার বাসায় ফোন করে বললো চারজন মেহমান আসবে তারা থাকবে, তিনজনের নাম বলে বললো আরেকজন আসলে দেখবা, ভাবী বলে “নিশ্চয়ই বুলেট ভাই”, কামাল ভাই বলে “তুমি বুঝলা কিভাবে”? যাইহোক আমরা সন্ধ্যার পর বের হলাম কিন্তু পথে আমাদের গাড়ি আক্রান্ত হলো কয়েকটা ইটের টুকরা গাড়িতে লাগলো খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।
বাসায় ফিরে দেখি তিন নেতাই এসে গেছে, শুরু হলো আন্দোলনের নতুন অধ্যায়, নেতারা আন্দোলন নিয়ে কিভাবে আলাপ-আলোচনা করেছেন, কিভাবে ৭ দল ৫ দলের নেতাদের সাথে সমন্বয় করে আন্দোলনের কর্মসুচী ঠিক করছেন, বিবিসি, ভয়েস আমেরিকার সাথে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন সবই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, এরমধ্যে প্রতিদিন তাস খেলার ব্যবস্থাও ছিল রাজ্জাক ভাই আমাকে বলে ” তুই আর আমি” আমিতো লজ্জায় কাচুমাচু তোফায়েল চাচার সাথে তাস খেলবো!! পরে চাচাই বললো বসো, তারপর রোজই ব্রিজ খেলার আসর বসতো।
এরমধ্যে নেত্রীর বাসার ফোন লাইন কেটে দিয়েছে, আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে পাঠানো হলো নেত্রীর বাসায়, লুঙ্গি পড়ে একটা চাদর গায়ে স্পন্সের স্যান্ডেল পায়ে গেলাম, আমার কাপড়-চোপড় দেখে নেত্রী বলে তোমার এই অবস্থা কেন? বললাম ছদ্মবেশ।
নেতারা কিভাবে কি করছে সবই জানালাম, তাস খেলি তা-ও বললাম, নেত্রী আমাকে বলে তুমিতো ভালই দায়িত্ব পালন করছো, দেখো বাসা থেকে বের হলে আবার না এরেস্ট করে, বললাম এজন্যই তো খুব সাধারণভাবে আসছি, তারপর একসাথে দুপুরের খাওয়া খেয়ে বাসায় ফিরেছি, আরেকদিন গেলাম ২৭ নভেম্বর, গিয়ে দেখি নেত্রী রাগ ও অস্থির, সেদিন জেনারেল নূরউদ্দিন সৌদি আরব থেকে ফিরে আসবে, বিষয়টা এমন ছিল যে, নুরুদ্দিন ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে! ফিরে এসে জানালাম এই অবস্থা, নেতারা আন্দোলন আরও জোরদার করার ঘোষণা দিলেন, ঐদিন সন্ধ্যায় মিরপুরে সেনাবাহিনীর গাড়ি আক্রমণ করা হলো এবং মিরপুর থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হলো, আমার বিবেচনায় সেটাই ছিল সেনাবাহিনী এরশাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার একটি বড় কারন, সেনাবাহিনী দেখলো জনগণ যেহেতু আর্মির গায়ে হাত দিয়েছে তাহলে এটা ছড়িয়ে পড়লে সিভিল ওয়ার হবে তাই তারা জনগনের বিপক্ষে দাড়াবেনা, আর এই বিবেচনাটাই এরশাদের পতন নিশ্চিত করে।
৩ ডিসেম্বর এরশাদ শেষ চেষ্টা হিসেবে নেত্রীকে ফোন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘোষণা সহ যা বলবে তা করার অঙ্গিকার করে একটা সুযোগ দিতে বলে, নেত্রী সাফ জানিয়ে দেন “আমার কিছুই করার নেই”, তার পরই ৪ তারিখ রাত ১০ টার ইংরেজি খবরের শেষ দিকে হঠাৎ এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণা আসে।
তোফায়েল চাচা নেত্রীকে ফোন করলেন নেত্রী সিনিয়র নেতাদের ডেকেছেন, কিছু কথার মধ্যে নেত্রী নাকি বলেছেন কেউ কেউ এ কে খন্দকারকে তত্বাবধায়ক প্রধান করার কথা বলেছে, আমি বললাম এটা কিভাবে সম্ভব! আমরা এতোদিন আন্দোলন করলাম এরশাদের বিরুদ্ধে তার মন্ত্রী কিভাবে এই পদে আসবে! তাছাড়া আগেইতো বলা আছে যে, প্রধান বিচারপতি হবে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান, তোফায়েল চাচা বলে ” তুমি গিয়ে তোমার বোনকে বলো” তখন রাজ্জাক ভাই-মানিক ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে ঠিক হলো ৫ দল থেকে লিয়াজো কমিটির মিটিংয়ে প্রস্তাব করা হবে প্রধান বিচারপতির নাম, তা নাহলে আওয়ামী লীগ বললে বিএনপি মনে করবে প্রধাম বিচারপতি আমাদের লোক।
নেতা (তোফায়েল চাচা) আমাকে বললেন চলো, লাল একটা টয়োটা পাবলিকা গাড়ি উনি নিজেই ড্রাইভ করলেন, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে ওঠার পর দেখলাম লোকে লোকারণ্য গাড়ি দেখলেই আটকায় মনে করে মন্ত্রীরা পালাচ্ছে, আমি গ্লাস নামিয়ে অর্ধেক শরীর বের করে হাততালি দিচ্ছি আর বলছি তোফায়েল ভাই গাড়িতে, অমনি লোকজন গাড়ি ঘিরে স্লোগান দিয়ে ৩২ নম্বরে নেত্রীর বাসায় নিয়ে যায়, নেতা বলে “তুমিতো সাংঘাতিক ইন্টেলিজেন্ট”!
৬৯ র গনঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে তোফায়েল আহমেদ হয়েছিলেন ” নায়ক” তা আমি দেখিনি কিন্তু ৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার দিকনির্দেশনা ও সাহসী ভুমিকা সাথে থেকে দেখার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সেই ২৪ শে মার্চ ৮২ থেকেই ছিলাম, ভোলায় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছি আর ঢাকায় আসার পর সকল মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিয়েছি, নেত্রীর সাথেও থাকার সৌভাগ্য হয়েছে তবে শেষ মুহূর্তে কিছু ভুমিকা রাখার দুর্লব সুযোগ দেওয়ার জন্য শ্রদ্বেয় নেতা তোফায়েল আহমেদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।

দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।